মারা গেলেন শেষ ঠিকানার কারিগর মনু মিয়া আর নেই

- আপডেট সময় : ০১:৩২:৪৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫ ৪৯ বার পড়া হয়েছে

ছবি:সংগৃহীত
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের এক প্রথিতযশা মানুষ, গোরখোদক মনু মিয়া, আর নেই। শনিবার সকাল ১০টার দিকে নিজ বাড়িতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৭৫ বছর।
মনু মিয়া কোনো সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না। জীবনের একটি দীর্ঘ সময় তিনি কাটিয়েছেন মৃত মানুষের শেষ আশ্রয়ের জায়গা—কবর খুঁড়ে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জীবদ্দশায় তিনি প্রায় ৩,৫০০টি কবর খনন করেছেন। তাঁর এ কাজ শুধুই পেশা ছিল না, বরং এক ধরনের নীরব সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তিনি কাজটি করতেন।
মনু মিয়ার জীবন যেমন ছিল ব্যতিক্রমী, তেমনি ছিল তাঁর চলার মাধ্যমটিও। কবর খননের ডাক পড়লেই তিনি বেরিয়ে পড়তেন ঘোড়ায় চড়ে। ঘোড়া ছিল তাঁর একমাত্র যাতায়াতের ভরসা, দীর্ঘ সময়ের বিশ্বস্ত সঙ্গী। কিন্তু এই প্রিয় সঙ্গীও কিছুদিন আগে এক রহস্যজনক ঘটনার শিকার হয়। ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকা অবস্থায় দুর্বৃত্তরা মনু মিয়ার ঘোড়াটিকে হত্যা করে।
ঘটনার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে দেশজুড়ে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। কিন্তু তখন মনু মিয়ার শারীরিক অবস্থা এতটাই দুর্বল ছিল যে, পরিবারের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন—ঘোড়ার মৃত্যুর খবর তাঁকে জানানো হবে না। পরবর্তীতে তিনি কিছুটা সুস্থ হলে, বড় সতর্কতার সঙ্গে তাঁকে সেই খবর জানানো হয়। ঘোড়ার মৃত্যুর পর মনু মিয়া মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকায় চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হয়ে মনু মিয়া নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। কিন্তু বার্ধক্যজনিত রোগ এবং প্রিয় সঙ্গীর শূন্যতা তাকে ভিতর থেকে গিলে ফেলছিল। শনিবার সকালেই নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, “মনু ভাই শুধু কবর খুঁড়তেন না, তিনি জানাজার আগে পরিবারের সঙ্গে বসতেন, মৃতের আত্মীয়দের সান্ত্বনা দিতেন। আজ তিনি নিজেই সেই কবরের ঘুমে চলে গেলেন, যেসব ঘুমন্ত মানুষকে তিনিই এতকাল শায়িত করেছেন।”
মনু মিয়ার মৃত্যু শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়, এটি যেন একটি অধ্যায়ের ইতি। এমন নিরলস শ্রমিক, এমন নিঃস্বার্থ মানুষ বিরলই বটে। জীবনের শেষদিকে চিকিৎসা, ঘোড়ার মৃত্যু, আর মানসিক যন্ত্রণা সব মিলিয়ে মনু মিয়ার জীবন যেন হয়ে উঠেছিল এক নিঃসঙ্গ যাত্রার গল্প।
তাঁকে আজ দাফন করা হবে সেই কবরস্থানে, যেখানকার প্রতিটি মাটি তাঁর হাতে ছোঁয়া। তবে এবার আর তিনি কবর খুঁড়বেন না, বরং মাটির গভীরে ঘুমিয়ে থাকবেন চিরকাল—নিজেরই খোঁড়া অসংখ্য কবরের মাঝে একটিতে।