নানা ইস্যু ঘিরে দেশে কয়েকদিন ধরে যে অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, দ্রুত সেটির উন্নতি চায় বিএনপি। দলটির অভিমত, অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠোরহস্তে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। বিএনপি মনে করছে, ‘পতিত’ স্বৈরাচারের পতন হলেও তাদের দোসররা এখনো প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। তারাই এ ধরনের চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত। দলটি আরও মনে করছে, পতিত ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে এলে অন্তর্বর্তী সরকারসহ গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দল ও জনগণের জন্য তা মঙ্গলজনক হবে না। তাই বিএনপি চায় না এ সরকার ব্যর্থ হোক। তারা সরকারকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছে।
এর অংশ হিসেবে দেশ যে জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সঠিকভাবে চলছে না এবং বিদ্যমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে বিএনপি যে উদ্বিগ্ন, সেটি অবহিত করতে শিগগির প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাদের একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করবে। এ ছাড়া পতিত ফ্যাসিবাদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সচেতন করতে শিগগির কর্মসূচি দেওয়ারও চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি। এ ইস্যুতে ঢাকায় একটি বিক্ষোভ সমাবেশ করতে পারে দলটি। গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নানা দাবি নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন রাজধানীতে প্রায় দিনই মিছিল, সমাবেশ ও বিক্ষোভ করছে। এর মধ্যে সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। ঢাকা মহানগরের সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ করার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিক্ষোভ করেন তারা। অবশ্য পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের ওই আদেশের ওপর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা দেওয়ায় ব্যাটারিচালিত রিকশা আপাতত চলতে পারবে। এদিকে গত কয়েকদিনে সংঘর্ষে জড়ায় রাজধানীর কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজে ভাঙচুরের প্রতিবাদে প্রতিষ্ঠান দুটির শিক্ষার্থীরা সোমবার যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এ সময় ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে একপক্ষ অন্যপক্ষের ওপর চড়াও হয়। এ ছাড়া ভুল চিকিৎসায় অভিজিৎ হাওলাদার নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অভিযোগের জেরে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালানো হয় ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট। বেতন-ভাতা নিয়ে বিভিন্ন গার্মেন্টসেও বিরাজ করছে অস্থিরতা। সোমবার বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশব্যাপী সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আট দফা দাবিতে সনাতনী সম্প্রদায়ের মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ।
বিদ্যমান এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে গত সোমবার রাতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ ১৯টি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র সংগঠনগুলো মনে করছে, নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে পতিত আওয়ামী লীগ ফের ফিরে আসতে চাইছে। ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় এখন ফ্যাসিবাদবিরোধী সুদৃঢ় ঐক্য প্রয়োজন। বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গতকাল মঙ্গলবার থেকে এক সপ্তাহ ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি’ পালন করছে ছাত্র সংগঠনগুলো। এর আওতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে একতা ও সংহতির বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন তারা।
জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও দেশের বিরাজমান এই অরাজক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দলটির নেতাদের অভিমত, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ এরই মধ্যে সাড়ে তিন মাসের বেশি হয়েছে; কিন্তু তারা এখনো প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরকে পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরমুক্ত করতে পারেনি। প্রশাসনে রদবদল করা হলেও ঘুরেফিরে আওয়ামী আশীর্বাদপুষ্টরাই চলে আসছে। অর্থাৎ সব জায়গায় আওয়ামী লীগের ক্রীড়নকরা রয়ে যাচ্ছে। দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীল করতে তারাই নানান চক্রান্তে লিপ্ত।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, প্রশাসনে যে আওয়ামী লীগের ক্রীড়নক রয়ে গেছে, সেটার শুদ্ধি অভিযান সরকার ঠিকমতো চালাতে পারছে না, যে কারণে দেশে নানান ধরনের ঘটনা ঘটছে। বিএনপি চায়, বর্তমান সরকার আরও শক্তিশালীভাবে, কঠোর হস্তে তাদের সব ষড়যন্ত্র-নৈরাজ্য দমন করুক; কিন্তু সেটা হচ্ছে না বলে মনে করে দলটি। কেন হচ্ছে না, সেটাই এখন প্রশ্ন বিএনপির। তাই দেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত নানান ঘটনায় বিএনপি যে উদ্বিগ্ন, সেটা অন্তর্বর্তী সরকারকে অবহিত করতে চায় দলটি।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আগে সেখানে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে দলটি। বৈঠকে বিএনপির পক্ষে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ছিলেন। অন্যদিকে মঞ্চের পক্ষে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, জেএসডির শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ূম ছিলেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সেখানেও দেশের বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। উভয় পক্ষের নেতারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার পুরোপুরি আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ আমলা পতিত ফ্যাসিবাদের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় সরকার জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না। এসব আমলাই সরকারকে অস্থিতিশীল করতে দেশের বিরুদ্ধে নানান ষড়যন্ত্র করছে। সরকারের উচিত, শক্ত হাতে সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা, প্রশাসনকে আওয়ামী দোসরমুক্ত করা। না হলে পতিত ফ্যাসিবাদ ফের পুনর্বাসিত হতে পারে, যেটা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দল গঠিত সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়। সে আলোকে গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, একই ব্যক্তির পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারা, উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী পদ সৃজনসহ ৬২টি সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে বিএনপি। আজকালের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সংস্কার প্রস্তাবও জমা দেবে দলটি।
সংবিধানসহ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ১৫ সংস্কার কমিশনের আলোকে বিএনপিও সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিটি করে। এর মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিটির প্রধান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ তার প্রতিবেদন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে জমা দিয়েছেন। বাকি কমিটিগুলোর রিপোর্টও চূড়ান্ত পর্যায়ে।