ছবি: সংগৃহীত
নাবালকের অভিভাবকত্ব ও জিম্মার বিষয়ে আইনি পর্যালোচনার ধারাবাহিকতায় এই খন্ডে আমরা নাবালকের জিম্মার বিষয়ে জানব। এখানে উল্লেখ্য গত খন্ডে আমরা নাবালকের অভিভাবকত্বের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি।
নাবালকের জিম্বার ক্ষেত্রে কার অগ্রাধিকার থাকবে তা নাবালক যে ধর্মের অনুসারী সেই ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত হয়, অর্থাৎ নাবালকের ব্যক্তিগত আইন নাবালকের জিম্মার বিষয়টি নির্ধারন করে। বাংলাদেশের মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইন “শরিয়ত প্রয়োগ আইন, ১৯৩৭” নামে পরিচিত। ব্যক্তিগত আইনের জিম্মার বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে প্রয়োগযোগ্য করে তুলার জন্য যে আইনটি ব্যবহৃত হয় তা হল “অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৮০”।
নাবালক সন্তানের জিম্মা ও তার আইনি বিশ্লেষন
নাবালক সন্তানের জিম্মার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম অগ্রাধিকার প্রাপ্ত ব্যক্তি হচ্ছেন নাবালকের মা এই ক্ষেত্রে নাবালকের পিতা কিংবা অন্য যে কারও অধিকার মায়ের অধিকারের পরে স্থান পায়। অর্থাৎ নাবালকের জিম্মার ক্ষেত্রে মায়ের অধিকার সবার উপরে। সাধারন অর্থে জিম্মার / হেফাজতের অধিকার বলতে বুঝায় নাবালকের লালন পালনের অধিকার। কিন্তু এই লালন পালনের অধিকারের সাথে অভিভাবকত্বের অধিকার সংযুক্ত নয়। অর্থাৎ নাবালকের জিম্মার অধিকার মায়ের থাকলেও তা হবে পিতার অভিভাবকত্বের শর্ত সাপেক্ষে। পিতা নাবালকের ব্যাপারে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহন করবেন অন্যদিকে মা নাবালকের দেখাশুনা ও লালন পালন করবেন। মাকে নাবালকের জিম্মার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়ার কারন হচ্ছে একজন মা অন্য যেকারোর চেয়ে তার সন্তানকে ভালভাবে লালন পালন করতে পারেন। মায়ের অবর্তমানে নাবালকের জিম্মার ক্ষেত্রে যারা অগ্রাধিকার পাবেন তারা হচ্ছেন নানি, দাদি, আপন বোন, খালা, ফুফু। তবে এক্ষেত্রে একটি কথা সবসময় মনে রাখতে হবে বাবার দিকের মহিলা আত্মীয়ের চেয়ে মায়ের দিকের মহিলা আত্মীয়গন বেশী অগ্রাধিকার পাবেন। নাবালক যদি ছেলে হয় সেক্ষেত্রে ৭ (সাত) বৎসর বয়স পর্যন্ত অন্যদিকে নাবালক যদি মেয়ে হয় সেক্ষেত্রে বয়সন্ধিতে উপনিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মা ও বাবার দিকের কোন মহিলা আত্মীয় না থাকলে শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্রে বাবা অথবা তার দিকের পুরুষ আত্মীয়রা নাবালকের জিম্মার অধিকার পাবেন (উদাহরন- দাদা, ভাই, চাচা)। তবে উপরোক্ত কোন আত্মীয় স্বজনের অনুপস্থিতিতে নাবালককে তার সাথে সর্ম্পকযুক্ত নন এমন কোন নিষিদ্ধ ধাপের ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়া যাবে না (অর্থাৎ নাবালককে এমন ব্যক্তির কাছে দেয়া যাবে না যার সাথে নাবালকের বিয়ে বৈধ)। এরকম পরিস্থিতিতে নাবালক কার জিম্মায় থাকবে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার একমাত্র এখতিয়ার রয়েছে আদালতের। আদালত “অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৮০” অনুসারে নাবালকের জিম্মাদার নিয়োগ করবেন। এক্ষেত্রে আদালত যাকে নিয়োগ করবেন তাকে অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে, তাছাড়া নিয়োগকৃত ব্যক্তিকে অবশ্যই স্বাভাবিক জ্ঞান সম্পন্ন শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ্য ব্যক্তি হতে হবে অন্যথায় আদালত তাকে নিয়োগ প্রদান করবেন না।
নাবালকের জিম্মার / হেফাজতের অধিকার নিম্নলিখিত বিধিনিষেধ দ্বারা সীমাবদ্ধ
১। অধিকারের প্রকৃতি : নাবালকের জিম্মার অধিকার শুধুমাত্র লালন পালন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। জিম্মার অধিকারী ব্যাক্তি নাবালকের ব্যক্তির ও সম্পত্তি সর্ম্পকিত কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। উদাহরন স্বরূপ বলা যায় পাঁচ বৎসর বয়সের কোন নাবালকের জিম্মার অধিকার তার মায়ের, মা তার লালন পালনের অধিকারী, অন্যদিকে নাবালক কোন স্কুলে পড়াশুনা করবে আদৌ স্কুলে পড়বে নাকি মাদ্রাসায় পড়বে ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহন করবেন নাবালকের অভিভাবক (নাবালকের অভিভাবক কে হবেন তা গত খন্ডে আলোচনা করা হয়েছে)।
জিম্মার অধিকারের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হচ্ছে মা তার নাবালক বাচ্চার অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে নাবালককে তার বসবাসের স্থান অথবা দেশ থেকে অন্য কোন দূরবর্তি স্থানে কিংবা দেশে নিয়ে যেতে পারবেন না। এইক্ষেত্রে অবশ্যই নাবালকের অভিভাবকের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির অনুমতি লাগবে। মায়ের জিম্মায় থাকা অবস্থায় নাবালকের পিতাকে অবশ্যই নাবালকের সাথে দেখা করার সুযোগ প্রদান করতে হবে। তবে এই ক্ষেত্রে মা নাবালককে তার পিতার বাসায় না পাঠিয়ে কোন তৃতীয় স্থানে দেখা করার ব্যবস্থা করতে পারবেন।
২। নাবালকের বয়স : নাবালকের জিম্মার বিষয়টি নাবালকের বয়স দ্বারা সীমাবদ্ধ। তবে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। নাবালক যদি ছেলে হয় সেক্ষেত্রে ৭ (সাত) বৎসর বয়স পর্যন্ত অন্যদিকে নাবালক যদি মেয়ে হয় সেক্ষেত্রে বয়সন্ধিতে উপনিত হওয়ার আগ পর্যন্ত নাবালকের জিম্মা পাবেন মা। মায়ের জিম্মার অবসান ঘটলে নাবালকের জিম্মার অধিকারী হবেন বাবা। তবে এক্ষেত্রে আমাদের একটি কথা অবশ্যই স্বরনে রাখতে হবে উপরে উল্লেখিত জিম্মাকালের সময় ও জিম্মার অধিকারের যে ধারাবাহিক ক্রমের কথা বলা হয়েছে তা অবশ্যই পালন করতে হবে নাবালকের “সর্বোচ্চ কল্যান নীতি” মাথায় রেখে। উদাহরন স্বরূপ সাত (৭) বৎসর অতিবাহিত হওয়ার পরও যদি দেখা যায় নাবালককে তার মায়ের জিম্মা থেকে সরিয়ে বাবার জিম্মায় দিলে তা নাবালকের জন্য ক্ষতির কারন হবে সেক্ষেত্রে আদালত মায়ের জিম্মার অধিকার প্রসারিত করতে পারেন, শুধু তাই নয় আদালত নাবালকের জিম্মার অধিকারী ব্যক্তিগনের ধারাবাহিক ক্রমের উপরের দিকের কাউকে বাদ দিয়ে নিচের দিকের কাউকে নিয়োগ করতে পারেন যদি তা নাবালকের জন্য কল্যানকর হয়।
জিম্মার অধিকার হারানোর কারন সমূহ
মা সাধারনত দুইটি কারনে জিম্মার অধিকার হারাতে পারেন।
১। আগন্তুক কিংবা অপরিচিত ব্যক্তিকে বিয়ে করলে
মা তার নাবালক সন্তানের জিম্মার অধিকার হারাবেন যদি তিনি এমন কোন ব্যক্তিকে বিয়ে করেন যিনি নাবালকের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নন (অর্থাৎ নাবালকের সহিত সর্ম্পকযুক্ত নন এমন কোন নিষিদ্ধ ধাপের ব্যক্তিকে বিয়ে করেন), উদাহরন স্বরুপ- একজন অপরিচিত ব্যাক্তি কিংবা আগন্তুক যার সাথে নাবালকের বিয়ে বৈধ। কিন্তু মা যদি নাবালকের চাচাকে বিয়ে করেন সেক্ষেত্রে নাবালকের জিম্মার অধিকার হারাবেন না কারন নাবালকের চাচা নাবালকের অতি নিকটের আত্মীয় এবং তার সাথে নাবালকের বিয়ে বৈধ নয় (নাবালক এবং তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর লিঙ্গ একই হলে তাদের দুইজনের লিঙ্গ ভিন্ন বলে ধরে নিতে হবে)।
২। অসামাজিক জীবন যাপন করলে
মা নাবালকের জিম্মা হারাবেন যদি তিনি অসামাজিক / অনৈতিক জীবন যাপন করেন। এই নিয়মের যৌক্তিকতা হচ্ছে অনৈতিক জীবন-যাপনকারী মায়ের সাথে নাবালক বসবাস করলে তার বিরূপ প্রভাব নাবালকের উপর পরতে পারে যা নাবালকের জন্য মোটেও কাম্য নয়।
নাবালকের সর্বোচ্চ কল্যান নীতি
নাবালকের জিম্মার ক্ষেত্রে নাবালকের “সর্বোচ্চ কল্যান নীতি” অন্য সকল নিয়মের উর্দ্ধে বিবেচনা করতে হবে। “সর্বোচ্চ কল্যান নীতি” প্রয়োগ করে আদালত মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের কোন নিয়ম ও ধারাবাহিকতা অনুসরন না করে নাবালকের কল্যানার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পারেন। উদাহরন স্বরূপ- মুসলিম ব্যক্তিগত আইন অনুসারে মা দ্বিতীয় স্বামী গ্রহন করলে নাবালকের জিম্মার অধিকার হারাবেন কিন্তু আদালত যদি মনে করেন নাবালক অন্য কারও জিম্মার চেয়ে মায়ের জিম্মায় বেশী নিরাপদ সেক্ষেত্রে আদালত দ্বিতীয় স্বামী গ্রহন করা সত্ত্বেও নাবালকের জিম্মার অধিকার মাকে দিতে পারেন। এই ধরনের নমনীয়তার কথা শরিয়া আইনেও (ইসলামিক আইন) বলা হয়েছে। অর্থাৎ নাবালকের জিম্মার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে আদালত “মুসলিম ব্যক্তিগত আইন” অনুসরন করবেন কিন্তু আদালত যদি মনে করেন ব্যক্তিগত আইন কঠোরভাবে অনুসরন করলে তা নাবালকের ক্ষতির কারন হতে পারে সেক্ষেত্রে আদালত “নাবালকের সর্বোচ্চ কল্যান নীতি” অনুসরন করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করবেন। উদাহরণ স্বরূপ-আদালত নাবালকের (নাবালক ছেলে হলে) বয়স সাত (৭) বৎসরের বেশী হলেও তার জিম্মা বাবার কাছে না দিয়ে মায়ের জিম্মার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেন কিংবা জিম্মার অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত উপরের স্তরের কাউকে নাবালকের জিম্মা না দিয়ে নিচের স্তরের কাউকে দিতে পারেন (যেমন নানিকে না দিয়ে দাদিকে দিতে পারেন।